নিজস্ব প্রতিবেদক
সিরাজগঞ্জের আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি জান্নাত আরা হেনরির হাতে যেন ধরা দিয়েছিল আলাদ্বিনের চেরাগ। নগদ টাকা, গাড়ি, বাড়ি আর সম্পদের পাহাড় গড়েছেন আওয়ামী লীগের ১৫ বছরে। ছিলেন স্কুলের সহকারী শিক্ষক। পৈত্রিকভাবেই তিনি রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। সে সূত্রেই তিনি রাজনীতিতে আসেন।
জান্নাত আরা হেনরি দ্বাদশ জাতীয় সংসদে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী হিসেবে এমপি নির্বাচিত হন। সংসদ সদস্য ছিলেন ৬ মাস ২৫ দিন। ছিলেন সিরাজগঞ্জ সদরের সবুজ কানন উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষিকা। সেখান থেকে আওয়ামী লীগের ১৫ বছরের শাসনামলে রাজনৈতিক নেত্রী এবং সংসদ সদস্য বনে যান। হেনরির অর্থ-সম্পদের পাহাড় গড়ার ইতিহাস রূপকথার মতোই বিস্ময়কর।
বর্তমানে হেনরির ব্যবহারযোগ্য গাড়ি ১৬টি। ঢাকা, সিরাজগঞ্জসহ বিভিন্ন স্থানে ফ্ল্যাট, জমিসহ বিঘায় বিঘায় সম্পদ। ৩৫টি ব্যাংক অ্যাকাউন্টে রয়েছে আড়াই কোটি টাকা জমা। এছাড়াও ১৩ কোটি ৭৮ লাখ ৪৬ হাজার ডলার রয়েছে।
২০০৮ সালে নবম সংসদ নির্বাচনে সিরাজগঞ্জ-২ সদর আসন থেকে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পান জান্নাত আরা হেনরি। তখন তিনি ছিলেন সিরাজগঞ্জ সদরের সবুজ কানন উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক। রবীন্দ্র সঙ্গীতেরও চর্চা করতেন তিনি। স্কুলেও শিক্ষার্থীদের গানের তালিম দিতেন।
সে সময় বিএনপির বর্তমান স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকুর স্ত্রী রুমানা মাহমুদের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পান হেনরি। মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার সময় নির্বাচন কমিশনে রিটার্ন তথ্য ও সম্পদ বিবরণী জমা দেন। ওই সময় তার মাসিক আয় দেখান ১০ হাজার টাকা। নগদ অর্থ ছিল মাত্র সাড়ে ৪ লাখ টাকা।
২০০৮ সালেও যিনি রিকশায় চড়ে স্কুলে যেতেন, তিনি বর্তমানে ১৬টি গাড়ির মালিক। সবগুলো গাড়িই ঢাকা ও মিরপুর সার্কেল থেকে রেজিস্ট্রেশন করা। হেনরি নিজে যেই গাড়িতে চড়েন সেটির (ঢাকা মেট্রো-ঘ-২১-৭৩৮৮) ক্রয়মূল্য দেখিয়েছেন ৯৫ লাখ টাকা। তদন্ত কর্মকর্তারদের ধারণা এই গাড়ির দাম কমপক্ষে ২ কোটি টাকা।
হেনরি পরিবারের সদস্যরা আরেকটি গাড়ি ব্যবহার করেন, যার নম্বর ঢাকা মেট্রো-ঘ-১২-২০৪৯। বিআরটিএতে এই গাড়ির ক্রয়মূল্য দেখিয়েছেন ৬১ লাখ টাকা। অথচ এর মূল্যও অনেক বেশি।
তার ৩৫টি ব্যাংক অ্যাকাউন্টে ২ হাজার ২ কোটি ৬৬ লাখ ৬৬ হাজার ৫৭৭ টাকা এবং ১৩ কোটি ৭৮ লাখ ৪৬ হাজার মার্কিন ডলারের সন্দেহজনক লেনদেন করে মানিলন্ডারিং করেছেন। অধিকাংশ সম্পদের তথ্য আয়কর নথিতে উল্লেখ করেনি। ৫৭ কোটি ১৩ লাখ ৭ হাজার ২২৩ টাকা জ্ঞাত আয় উৎসের সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ সম্পদ অর্জন করেছেন সাবেক এই এমপি।
হেনরির সম্পদের মধ্যে রয়েছে সিরাজগঞ্জ সদরে ৭ তলা ভবন, যার দলিলমূল্য দেখানো হয়েছে ২ কোটি ২২ লাখ ৫০ হাজার টাকা। সিরাজগঞ্জে ১টি ফ্ল্যাট, দলিলমূল্য ৩৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা। ঢাকার মিরপুরে রজনীগন্ধা কমপ্লেক্সে ২টি ফ্ল্যাটের মূল্য ৫০ লাখ টাকা; সিরাজগঞ্জের বাহুকা রতনকান্দি এলাকায় ৪ হাজার বর্গফুটের ২ তলা ভবনের মূল্য ১ কোটি ৩০ লাখ টাকা; সিরাজগঞ্জের ভূতের দিয়া এলাকায় ০.০৬৩৭ শতাংশ জমিসহ ভবনের মূল্য ৮২ লাখ ১৪ হাজার টাকা; ভূতেরদিয়ায় ০.০৭০০ একর জমি মূল্য ২ কোটি ২২ লাখ ৫ হাজার টাকা এবং নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের কামতা মৌজার ১৭ নং সেক্টরের ৪০২ নং সড়কের ৮ নং প্লটের ৫ কাঠা জমির মূল্য দেখিয়েছেন ২২ লাখ ২০ হাজার টাকা। একই সেক্টরের ৩০৫ নং সড়কের ৪ নং প্লটের ৪ কাঠা জমি ক্রয় করেছেন ২২ লাখ ২০ হাজার দলিলমূল্য দেখিয়ে। পটুয়াখালির খেপুপাড়ায় ২.৫১ একর জমি কিনেছেন ১ কোটি ১০ লাখ ৯২ হাজার টাকায়।
সিরাজগঞ্জ সদরের বাহুকা-রতনকান্দি এলাকায় ১১টি পৃথক দলিলে সাড়ে ৩ একর জমি ক্রয় করেছেন। এসব সম্পদের দলিলমূল্য দেখানো হয়েছে ৫৫ লাখ ৮২ হাজার টাকা। সিরাজগঞ্জের পূর্ব মোহনপুরে ০.৬১ একর জমি কিনেছেন ১৯ লাখ ৮৬ হাজার ১৮০ টাকা মূল্যে। শিলন্দা ও বনবাড়ীয়ায় ৪.৬ একর জমি ক্রয় করেছেন ১ কোটি ৬ লাখ ৯০ হাজার ৫৫৬ টাকা দলিলমূল্যে। সদানন্দপুরে ৫টি পৃথক দলিলে ৪৫.১৫ শতাংশ জমি কিনেছেন ৭৮ লাখ ৮৮ হাজার ৪৯৩ টাকায়, যা আয়কর নথিতে প্রদর্শিত আছে।
এ ছাড়া সিরাজগঞ্জের ভারাঙ্গা এলাকায় ১২টি পৃথক দলিলে ৫ একর সম্পত্তি ক্রয় করেছেন ১ কোটি ১১ লাখ ৩৬ হাজার ৪০০ টাকা দলিলমূল্যে। রায়গঞ্জে ২.১৮ একর জমি মূল্য ৩০ লাখ টাকা।
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর জান্নাত আরা হেনরি ও তার স্বামী শামীম তালুকদার লাবু আত্মগোপনে চলে যান। তবে একই বছর ৩০ সেপ্টেম্বর মৌলভীবাজার থেকে গ্রেফতার হন। বর্তমানে তারা কারাগারে রয়েছেন।
