নিজস্ব প্রতিবেদক
রাজনৈতিক বিবেচনায় কেনা ইভিএম প্রকল্পে দেশের চার হাজার কোটি টাকা গচ্ছা গেছে। ক্ষমতাচুত্যত আওয়ামী লীগ সরকার রাজনৈতিক দল এবং নাগরিক সমাজের ব্যাপক আপত্তি উপক্ষো করে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে প্রায় চার হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে দেড় লাখ ইভিএম ক্রয় করে তৎকালীন কে এম নূরুল হুদার নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন। সেই বহুল আলোচিত প্রকল্পটি সোমবার বর্তমান কমিশন বাতিল করে দিয়েছে। ফলে দেশের অপচয় হয়েছে চার হাজার কোটি টাকা। এ বিষয়ে অনিয়মের ঘটনা খতিয়ে দেখছে দুদক।
‘ভোট চুরির নীরব যন্ত্র’ হিসেবে খ্যাত ইভিএম। এর মাধ্যমে সফটওয়্যারে কারসাজি করে নিরবে ভোট চুরি করা যায়।
সোমবার কমিশন সভায় এমন সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এর আগে ত্রয়োদশ নির্বাচন যে কেবলই ব্যালট পেপারের মাধ্যমে হবে তাও স্পষ্ট করেছেন প্রধান নির্বাচন কমিশন।
গত শনিবার সিলেটে সিইসি এএমএম নাসির উদ্দিন বলেছেন, আগামী জাতীয় নির্বাচন ইভিএমের মাধ্যমে হবে না, এটা পরিষ্কার। আগামী জাতীয় নির্বাচন ইভিএমের মাধ্যমে করার কোনো পরিকল্পনা আমাদের নেই। নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান ড. বদিউল আলম মজুমদার সম্প্রতি জানিয়েছেন, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ইভিএমের ব্যবহার করা হবে না।
ইভিএম প্রকল্প যেভাবে নেয়া হয়: ড. এটিএম শামসুল হুদার নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন দেশের ভোট ব্যবস্থায় ইভিএমের ব্যবহার শুরু করে। সে সময় তারা বুয়েট থেকে ১২ হাজার টাকা ব্যয়ে যন্ত্র তৈরি করে নেয়। ওই কমিশনের ধারাবাহিকতায় পরবর্তী সময়ে কাজী রকিবউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বাধীন কমিশনও ভোট যন্ত্রটি ব্যবহার করে। তবে ২০১৫ সালে রাজশাহী সিটি নির্বাচনে একটি মেশিন অচল হয়ে পড়ায় তা আর ব্যবহার উপযোগী করতে পারেনি রকিব কমিশন। পরবর্তী সময়ে তারা বুয়েটের তৈরি স্বল্প মূল্যের ওই মেশিনগুলো পুড়িয়ে ফেলার সিদ্ধান্ত দিয়ে উন্নতমানের ইভিএম তৈরির পরিকল্পনা রেখে যায়। এরই ধারাবাহিকতায় ২০১৭ সালে কেএম নূরুল হুদার কমিশন এসে বুয়েটের তৈরি ইভিএমের চেয়ে প্রায় ২০ গুণ বেশি দামে মেশিন কেনার সিদ্ধান্ত নেয়। ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ঠিক আগ মুহূর্তে বাংলাদেশ মেশিন টুলস ফ্যাক্টরির (বিএমটিএফ) কাছ থেকে মেশিনপ্রতি ২ লাখ ৩৫ হাজার টাকা ব্যয়ে ৩ হাজার ৮২৫ কোটি টাকায় দেড় লাখের মতো ইভিএম ক্রয় করে। কিন্তু পাঁচ বছর পার না হতেই ৯০ ভাগ ইভিএম অকেজো হয়ে পড়ে।
ইভিএমকেন্দ্রিক লুটপাট থেকে পিছিয়ে থাকতে চায়নি ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর পদত্যাগ করা কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন কমিশনও। দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনে শুরুতে দেড়শ আসনে ইভিএমে ভোট করার পরিকল্পনা নেয় তারা। সেজন্য নির্বাচন সামনে রেখে অকেজো মেশিন মেরামত, সংরক্ষণ প্রভৃতির জন্য তারা ৮ হাজার ৭১১ কোটি টাকার প্রকল্প প্রস্তাব দেয় সরকারের কাছে। তবে ওই সময় চরম অর্থনৈতিক সংকট থাকায় সরকার সেটি নাকচ করে দিতে বাধ্য হয়। তবে বড় প্রকল্প বাতিল হয়ে গেলেও বসে থাকেনি কমিশন। ফলে হাতে থাকা পুরোনো ইভিএমগুলো সচল রাখতে আবারো ১ হাজার ২৫৯ কোটি ৯০ লাখ টাকার চাহিদাপত্র দেয় আউয়াল কমিশন। ইভিএম মেরামতের জন্য প্রয়োজনীয় টাকা বরাদ্দ চেয়ে চিঠি চালাচালি এবং অর্থ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে একাধিক বৈঠকের পরও ইতিবাচক সাড়া না পেয়ে চরম হতাশ হয় সংস্থাটি। আর ৭ই জানুয়ারি অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনে কোনো আসনেই ইভিএমে ভোট গ্রহণ না করে সব আসনেই ব্যালটে ভোট নেয়া হয়। অন্যদিকে দেশের বিভিন্ন স্থানে পড়ে থাকা ইভিএমগুলো বর্তমানে ময়লা আবর্জনার ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে।
এদিকে সোমবার ‘গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ ১৯৭২, সংশোধন অধ্যাদেশ ২০২৫’ চূড়ান্ত করা হয়েছে। গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে (আরপিও) আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংজ্ঞায় সশস্ত্র বাহিনী বিভাগকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। ‘না’ ভোটের বিধান ফিরিয়ে আনা হয়েছে। কোনো আসনে একজন প্রার্থী থাকলে সেখানে বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হবে না। সেখানে না ভোট হবে প্রতিদ্বন্ধি। দুইজন প্রার্থী সমপরিমাণ ভোট পেলে লটারি নয় পুনরায় নির্বাচন হবে। আর না ভোট জীয় হলেও পুনরায় নির্বাচন হবে।
