নিজস্ব প্রতিবেদক
জুলাই একটা অনেক বড় ধরনের অভিজ্ঞতা ছিল। কিন্তু আমি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখপাত্র হওয়ার পর প্রথম আবিষ্কার করেছি যে এগুলো দিয়ে লোকজন নানা কিছু করছে। আমার কখনো মাথায়ই আসেনি যে এগুলো দিয়ে টাকা-পয়সা ইনকাম করা যায়। তাই বলে আমি এটাকে মানি মেকিং মেশিনে পরিণত করতে যাবো? কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে সেটা হয়েছে। খুবই কমন, খুবই রেগুলার বেসিসেই হয়েছে। জুলাই কেন মানি মেকিং মেশিন হবে? আনফরচুনেটলি সেটা হয়েছে।
রোববার রাতে ফেরিফাইড ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে লাইভে এসে জুলাই আন্দোলন নিয়ে এভাবেই নিজের অভিব্যক্তি তুলে ধরেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক মুখপাত্র উমামা ফাতেমা। ২ ঘণ্টা ২৪ মিনিটের সেই লাইভে কথা বলার সময় তাকে অনেক সময় আবেগ আপ্লুত হতে দেখা যায়।
তিনি চাঁদাবাজির অভিযোগের বিষয়ে বলেন, আমার বাড়ি চট্টগ্রামে। আমার অনেক আত্মীয় রয়েছে। আমি জানি ৫ই আগস্টের পর থেকে চট্টগ্রাম বন্দরে কী কী হয়েছে। শুধু চট্টগ্রামের কাহিনী সলভ করতে গেলে অনেকের প্যান্ট খুলে যেতো। এ রকম আরও অনেক জেলার কাহিনী রয়েছে। আমি তো এগুলো নিয়ে কাজ করি নাই। শোকর করো যে আমি কাজ করি নাই। ন্যূনতম আত্মসম্মান আছে, এমন কেউ এই প্ল্যাটফরমে টিকতে পারবে না। আমার মনে হয়, গত এক বছরে আমার অনেক সময় নষ্ট হয়েছে। তাদের হয়তো স্বপ্ন ছিল চাঁদাবাজি করবে। আমাকে ডেকে এনে আপনি একটা টিস্যু পেপারের মতো ব্যবহার করেছেন। আমি টিস্যু পেপার না। টেন্ডার বাণিজ্য, তদবির বাণিজ্য, ডিসি নিয়োগ, তমুক জায়গায় তমুক কাজ- এগুলো নাকি অহরহ করে বেড়াচ্ছে। মুখপাত্র হওয়ার আগে এগুলো নিয়ে আমার ধারণা ছিল না।
উমামা বলেন, অনেকে বলেন যে আমি হাজার-কোটি টাকা কামিয়েছি। আমি এতটুকু বলতে পারি, আই হ্যাভ এ প্রিটি গুড লাইফ। আমার পরিবার আমাকে কোনো মানি মেকিং মেশিন হিসেবে ব্যবহার করে না। পরিবার আমাকে একটা হিউম্যান বিং হিসেবে দেখে এবং চায় যে দেশের জন্য আমি ভালো কিছু করি। আমার পরিবার কোনো রাজনৈতিক পরিবার না। আমার বাড়িতে প্রচুর বই রয়েছে। ছোটবেলা থেকেই প্রচুর বই পড়েছি।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক এই মুখপাত্র বলেন, ৫ই আগস্টের পরদিন দেখি, সমন্বয়ক পরিচয়ে নাকি একেকজন একেক জায়গায় গিয়ে দখল করছে। আমি এক রকম অবাক হয়ে যাই যে গতকাল পর্যন্ত তো সমন্বয়ক পরিচয়টা দিতেই চাইছিল না আর আজকে থেকে শুনছি সবাই সমন্বয়ক, এই পরিচয়ে চাঁদাবাজি করছে। এখন কি রক্ষীবাহিনীর মতো সমন্বয়কবাহিনী তৈরি হচ্ছে নাকি। সে সময় আমার মনে হয়েছিল, এখন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন প্ল্যাটফরমটার আর দরকারটা কী, এখন তো সবাইকে অ্যাকোমোডেট করা নিয়ে ভাবা উচিত। আমি বলেছিলাম এই প্ল্যাটফরমটাকে আরও ব্রড ও ডিসেন্ট্রালাইজ করে ফেলা উচিত। ওই এ কথাটা বলে আমি অনেক মানুষকে শত্রু বানিয়ে ফেলি। এত মানুষ আমাকে খারাপ ভাবা শুরু করে যে, আমি রীতিমতো তবদা খেয়ে যাই। পরে জেলায় জেলায় গিয়ে দেখেছি, অনেক ভালো ভালো ছেলে কিছু করতে চায়। ওরা দেশটাকে পুনর্গঠন করবে।
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় উমামা ফাতেমা ছিলেন ছাত্র ফেডারেশনের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সদস্য সচিব। এরপর ফেডারেশন থেকে পদত্যাগ করে যোগ দেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে। গত বছরের অক্টোবরে তাকে এই প্ল্যাটফরমের মুখপাত্রের দায়িত্ব দেয়া হয়। যোগ দেয়ার ঘটনা বর্ণনার পর তিনি বলেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সবগুলো সিদ্ধান্ত হেয়ার রোডে বসে ঠিক করা হতো সেগুলোই বাস্তবায়ন হতো। আমি পুরো প্রক্রিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছি বলে মনে হতো। সবকিছু হিজিবিজি লাগতো। এসব বলতে বলতে তিনি কিছুটা কান্নায় ভেঙে পড়েন।
হঠাৎ করেই ৩১শে ডিসেম্বর জুলাই ঘোষণাপত্র কর্মসূচি দেয়া হয় উল্লেখ করে উমামা বলেন, পুরো ব্যাপারটা নিয়ে আমি খুব বিরক্ত ছিলাম। জানুয়ারির ১০/১৫ তারিখের মধ্যে শুনি যে তারা দল গঠনের প্রক্রিয়ায় ঢুকে গেছে। আমি দলের সঙ্গে যেতে আগ্রহী ছিলাম না। জানুয়ারির শেষ দিকে আমি ঠিক করে ফেলি যে এই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে আমি আর থাকবো না। আমাকে যোগ দিতেও বলা হয়। কিন্তু এরপর অভিযোগ করা হয়, আমি প্ল্যাটফরম দখলের চেষ্টা করছি। এই প্ল্যাটফরমকে আমার কাছে খুব বেশি মূল্যবান মনে হচ্ছিল না। যদিও অনেকের কাছে খুব মূল্যবান ছিল, কারণ এটা নিয়ে ডিসি, এসপি কার্যালয়সহ বিভিন্ন সরকারি দপ্তরে দৌড়ানো যেতো।
জুলাই আন্দোলনের প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, ছাত্র ফেডারেশন করার সময় অনেকবার দেখেছি, ৩০-৪০ জনের মিছিলের সময় বলতাম- স্বৈরাচার নিপাত যাক। কিন্তু কখনো ভাবিনি, এই স্লোগান দিতে দিতে শিশুসহ সবাই রাস্তায় নেমে জীবন দেবে। জুলাই-আগস্টে সাধারণ মানুষকে নিয়ে ফাইট করেছি। এ কারণে এক বছর ধরে টিকে ছিলাম। কারণ আমরা একটা স্বপ্ন দেখছিলাম। ৫ই আগস্টের পর আর পারছিলাম না। দেশকে আরও বড় কিছু দেয়ার চিন্তা থেকে ফেডারেশন থেকে সরে গিয়ে স্বাধীনভাবে কাজ শুরু করি। তখন আমি বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন থেকে বিচ্ছিন্ন ছিলাম। আমাকে ডাকতো না। কারণ হতে পারে, আমি প্ল্যাটফরমটি বন্ধ করে দিতে বলেছিলাম।
জুলাই আন্দোলনে সমন্বয়কদের ভূমিকা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ৫২, ৬২ বা ১৫৮ জন সমন্বয়ক যে হয়েছে, সেগুলো সেভাবে ফাংশন করছিল না। মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে যোগ দিচ্ছিল। তবে সমন্বয়ক টার্মটা সে সময় দরকার ছিল, যাতে সবাইকে কানেক্ট করা যায়। আমার কাছে মনে হয়েছে, সমন্বয়কদের চেয়ে অন্যদের সহযোগিতা বেশি পেয়েছিলাম। সমন্বয়ক বাহিনী হয়তো সেভাবে অস্ত্র দিয়ে হয়নি। কিন্তু তখন সবার সঙ্গে আলাপ করে আমার মনে হয়েছে, এখন আসলে বৈষম্যবিরোধী প্ল্যাটফরমের আসলে দরকার কী? এটা তো শুধু ছাত্রদের। এখন সবাইকে অ্যাকোমোডেট করা যায়, সেটা ভাবা উচিত। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন থেকে গণ-অভ্যুত্থান হয়েছে, তাদের আর কিই বা করার আছে। এটা আরও বেশি ছড়িয়ে দেয়া উচিত
