নিজস্ব প্রতিবেদক
ছাত্রদলের হল কমিটি ঘোষণার প্রতিবাদে এবং আবাসিক হলগুলোতে সব ধরনের ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধের দাবিতে শুক্রবার রাতভর উত্তাল ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। হাজার হাজার শিক্ষার্থীর বিক্ষোভ ও ভিসির বাসভবন ঘেরাওয়ের মুখে আবাসিক হলে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধের আগের সিদ্ধান্ত বহাল রাখার ঘোষণা দেন ভিসি অধ্যাপক ড. নিয়াজ আহমেদ খান।
গত শুক্রবার বিকেল থেকেই কয়েকটি ছাত্রী হলের শিক্ষার্থীরা ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধের দাবিতে হল প্রশাসনের সাথে আলোচনায় বসেন। কিন্তু ছাত্রদলের কমিটি ঘোষণার পর পরিস্থিতি উত্তপ্ত হতে শুরু করে। পরে মধ্যরাতে এই বিক্ষোভ বড় আকার ধারণ করে। এর আগে শুক্রবার ঢাবির ১৮টি হলে ছাত্রদল কমিটি ঘোষনা করে।
রাত সাড়ে ১২টার দিকে রোকেয়া ও শামসুন নাহার হলের ছাত্রীরা হলের প্রধান ফটকের তালা ভেঙে বিক্ষোভে যোগ দেন। এর আগে থেকেই মুহসীন হলসহ অন্যান্য হলের শিক্ষার্থীরা রোকেয়া হলের সামনে জড়ো হয়েছিলেন। রাত ১টার দিকে কয়েক হাজার শিক্ষার্থীর সম্মিলিত মিছিল ভিসির বাসভবনের দিকে অগ্রসর হয় এবং ঘেরাও করে। ভোর রাত সাড়ে ৩টা পর্যন্ত এই ঘেরাও কর্মসূচি চলে। অবশেষে ভিসি শিক্ষার্থীদের আশ্বাস দিলে তারা আনন্দ মিছিল নিয়ে নিজ নিজ হলে ফিরে যান।
শিক্ষার্থীদের দাবিগুলো ছিল : ১) ছাত্রদল ও ছাত্র ইউনিয়নের সদ্য ঘোষিত হল কমিটি বাতিল করতে হবে এবং পদপ্রাপ্তদের হলের সিট বাতিল করতে হবে। ২) ছাত্রদলকে তাদের এই কর্মকাণ্ডের জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা চাইতে হবে। ৩) হলগুলোতে বিদ্যমান সব রাজনৈতিক সংগঠনের গুপ্ত ও প্রকাশ্য কমিটি বিলুপ্ত করতে হবে। ৪) যথাযথ সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচন আয়োজন করতে হবে। ৫) ২০২৪ সালের ১৭ জুলাই আবাসিক হলে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধের যে নীতিমালা গৃহীত হয়েছিল, তা কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে।
শিক্ষার্থীদের এই বিক্ষোভ শুধু মিছিল ও স্লোগানেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। রাত ১২টার দিকে মাস্টারদা সূর্যসেন হলে শিক্ষার্থীরা গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদের কর্মীদের সাথে নিয়ে শিবির ও ছাত্রদলের দেয়া পানির ফিল্টার ভেঙে ফেলেন। রোকেয়া হলের ছাত্রীরাও শিবিরের অনুদানে স্থাপিত ফিল্টার, ছাত্র অধিকার পরিষদের ভেন্ডিং মেশিন এবং ছাত্রদলের দেয়া ডাস্টবিন বর্জনের ঘোষণা দেন। শিক্ষার্থীরা ছাত্রদলের এই কমিটিকে ‘জুলাই অভ্যুত্থানের’ সাথে বিশ্বাসঘাতকতা হিসেবে অভিহিত করেছেন।
শিক্ষার্থীরা বলেছেন, আমরা জুলাই অভ্যুত্থানে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম হলে রাজনৈতিক আধিপত্যের অবসান ঘটাতে। এই নোংরা রাজনীতি গণরুম, গেস্টরুম ও কৃত্রিম সিট সঙ্কট তৈরি করে শিক্ষার পরিবেশ নষ্ট করে। আর কত জীবন দিলে হলে ছাত্ররাজনীতির ভয়াল থাবা বন্ধ হবে?
এদিকে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক মুখপাত্র ও ছাত্র ফেডারেশনের সাবেক সভাপতি উমামা ফাতেমা শুক্রবার রাতের মধ্যেই ছাত্রদলের কমিটি স্থগিত করার আল্টিমেটাম দেন। তা না হলে সাধারন শিক্ষার্থীদের নিয়ে কঠোর আন্দোলন গড়ে তোলা হবে।
শিক্ষার্থীদের দাবির মুখে ভিসি অধ্যাপক ড. নিয়াজ আহমেদ খান বলেন, “২০২৪ সালের ১৭ জুলাই হলগুলোতে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করার যে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল, সেটিই বহাল থাকবে। প্রত্যেক হল প্রশাসন এই নীতিমালার আলোকেই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে।”
পরদিন শনিবার এ বিষয়ে আলোচনার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভোস্ট স্ট্যান্ডিং কমিটি বৈঠকে বসে। তবে সভায় শিক্ষার্থীদের দাবিগুলো নিয়ে আলোচনা হলেও কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়নি বলে একজন প্রভোস্ট জানান।
ব্যাপক প্রতিবাদের মুখে কমিটি ঘোষণার ১৪ ঘণ্টার মধ্যেই ছাত্রদলের চারটি হল কমিটির ছয় নেতাকে সাংগঠনিক পদ থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। ‘তথ্য গোপনের’ অভিযোগে তাদের বিরুদ্ধে এই ব্যবস্থা নেয়া হয়। অব্যাহতিপ্রাপ্তরা হলেন: ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ হল কমিটির আহ্বায়ক মোসাদ্দেক আল হক শান্ত ও সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক রাকিবুল হাসান সৌরভ, শামসুন নাহার হল কমিটির সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক নিতু রানী সাহা, মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান হল কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক রাজু শেখ এবং হাজী মুহম্মদ মুহসীন হল কমিটির সদস্য আহমেদ জাবির মাহাম ও এন এস সায়মন।
তবে কমিটিগুলো পুরোপুরি স্থগিত করা হবে কি না, সে বিষয়ে ছাত্রদলের পক্ষ থেকে কোনো স্পষ্ট ঘোষণা আসেনি।
এদিকে শনিবার ছাত্রদল ঢাবির হলে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করার প্রতিবাদে ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ মিছিল করেছে। তবে তারা কোন শ্লোগান দেয়নি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পর এবার শনিবার রাতে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলোতে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধের দাবিতে বিক্ষোভ করেছেন একদল শিক্ষার্থী। রাত পৌনে নয়টার দিকে উপাচার্য অধ্যাপক মোহাম্মদ কামরুল আহসানের বাসভবনের সামনে অবস্থান নিয়ে তাঁরা বিক্ষোভ শুরু করেন। পরে রাত সাড়ে ১০টার দিকে এ নিয়ে উপাচার্যের আলোচনার আশ্বাসে শিক্ষার্থীরা ফিরে যান। আজ রোববার এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যারয়ে আলোচনা হবে বলে জানা গেছে।
এর আগে সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার দিকে মিছিল নিয়ে বিভিন্ন হলের সামনে গিয়ে মাইকিং করে শিক্ষার্থীদের কর্মসূচিতে যোগদানের জন্য আহ্বান জানান একদল বিক্ষোভকারী। পরে তাঁরা মিছিল নিয়ে উপাচার্যের বাসভবনের সামনে যান। একপর্যায়ে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলতে আসেন উপাচার্য মোহাম্মদ কামরুল আহসান। এ সময় শিক্ষার্থীরা তাঁর কাছে ছয় দফা দাবি জানান।
শিক্ষার্থীদের দাবিগুলো হলো জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সব হলে সব ধরনের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ, ভবিষ্যতে হলে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত শিক্ষার্থী এবং গণরুম ও গেস্টরুমে র্যাগিং সংস্কৃতিতে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক শাস্তির সুনির্দিষ্ট রূপরেখা প্রণয়ন, অতি দ্রুত হল সংসদ গঠন করে শিক্ষার্থীদের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করার ব্যবস্থা, রাজনৈতিক সংগঠনের যেকোনো উপহারসামগ্রী একমাত্র হল প্রশাসনের মাধ্যমে প্রদান এবং এতে ওই সংগঠনের নাম বা কোনো চিহ্ন ব্যবহার না করা, হলের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বহিরাগতদের অযাচিত হস্তক্ষেপ বন্ধ, হলের মেয়াদোত্তীর্ণ ছাত্রদের বিরুদ্ধে অনতিবিলম্বে ব্যবস্থা গ্রহণ।
বিক্ষোভকারী শিক্ষার্থীরা বলেন, শুক্রবার বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৭টি হলে ছাত্রদলের কমিটি দেওয়া হয়েছে। এরপর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। এর পরিপ্রেক্ষিতে হলভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবিতে শনিবার বিক্ষোভ মিছিল বের করেন তাঁরা।
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মোহাম্মদ কামরুল আহসান বলেন, আগামীকাল রোববার তিনি প্রশাসনিক সভা করবেন। ওই সভায় তিনি শিক্ষার্থীদের দাবিগুলো নিয়ে আলোচনা করবেন।
উপাচার্যের এই আশ্বাসের পর শিক্ষার্থীরা হলে ফিরে যান।
