বাংলাদেশি উদ্যোক্তাদের দেশ থেকে বৈদেশিক মুদ্রায় পুজি নিয়ে বিদেশে বিনিয়োগ করার প্রবনতা বেড়েছে। দেশ থেকে ২০২৩ সালে নিট মূলধন বা বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ে বিদেশে বিনিয়োগ করা হয়েছিল ১ কোটি ১৩ লাখ ডলার বা ১৩৮ কোটি টাকা। গত বছর নেওয়া হয়েছে ২ কোটি ৪৯ লাখ ডলার বা ৩০৪ কোটি টাকা। এক বছরে পুজি নেওয়ার প্রবনতা বেড়েছে ১ কোটি ৩৬ লাখ ডলার বা ১৬৬ কোটি টাকা। বৃদ্ধির হার ১২০ দশমকি ১০ শতাংশ। এসব অর্থের বড় অংশই বিনিয়োগ করা হয়েছে ভারতে। তবে বিদেশে কার্যরত কোম্পানিগুলোর অর্জিত মুনাফা দেশে না এনে পুনরায় বিনিয়োগ করার প্রবনতা গত এক বছরের ব্যবধানে কমেছে সাড়ে ৩৫ শতাংশ। পাশাপাশি বিদেশে বাংলাদেশি উদ্যোক্তাদের পরিচালিত এক কোম্পানি থকে অন্য কোম্পানি ঋণ নিয়ে বিনিয়োগ করার প্রবনতাও কমেছে। বরং তারা আগের ঋণ পরিশোধ করছে বেশি। গত এক বছরের ব্যবধানে এ ধরনের ঋণ পরিশোধ বেড়েছে ১৯ শতাংশ।
বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রকাশিত এক প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। বৈদেশিক ঋণ, বৈদেশিক বিনিয়োগের হাল্রনাগাদ তত্য উপাত্ত নিয়ে প্রতি ছয় মাস পর পর প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়। এবারের প্রতিবেদন গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত তথ্য দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশি উদ্যোক্তাদের বিদেশে বিনিয়োগের এ তথ্য কেবলমাত্র যেসব উদ্যোক্তা বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে অনুমোদন নিয়ে বৈধভাবে বিনিয়োগ করেছেন তার হিসাব। এর বাইরে দেশ থেকে পাচার করে বা বেআইনীভাবে এরচেয়ে আরও অনেক বেশি পুজি বিদেশে বিনিয়োগ করা হয়েছে। সম্প্রতি দুর্নীতি বিরোধী তদন্ত কার্যক্রমে এসব তথ্য বেরিয়ে আসছে।
প্রতিবেদন থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা যায়, ২০২২ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত টানা তিন বছর দেশে সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগ বা এফডিআই কমেছে। একই সঙ্গে ২০২৩ সালের তুলনায় ২০২৪ সালে বৈদেশিক ঋণ কিছুটা বাড়লেও ঋণ পরিশোধ বাড়ানোর ফলে গত সেপ্টেম্বরের তুলনায় ডিসেম্বরে ঋণের স্থিতি কমেছে। আলোচ্য সময়ে স্বল্প মেয়াদী বৈদেশিক ঋণ কমছে, বাড়ছে দীর্ঘ মেয়াদী বৈদেশিক ঋণ। যা ইতিবাচক হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। কারণ স্বল্প মেয়াদী ঋণেই রিজার্ভের ওপর চাপ বাড়ায় বেশি।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২৩ সালে দেশ থেকে বিদেশে নিট পুজি নেওয়া হয়েছিল ৫৫ লাখ ৯০ হাজার ডলার। গত বছরে নেওয়া হয়েছে ৭১ লাখ ৬০ হাজার ডলার। এ হিসাবে এক বছরে বিদেশে পুচি নেওয়ার প্রবনতা বেড়েছে ১৫ লাখ ৭০ হাজার ডলার। বৃদ্ধির হার ২৮ দশশকি ১০ শতাংশ। তিনটি পদ্ধতিতে এসব পুজি নেওয়া হয়। এর মধ্যে নিট মূলধন বা বৈদেশিক মুদ্রা হিসাবে, বিদেশে কার্যরত কোম্পানির অর্জিত মুনাফা দেশে না এনে পুনরায় বিদেশে বিনিয়োগ করা এবং বিদেশে এক কোম্পানি অন্য কোম্পানি বা আন্ত:কোম্পানি থেকে ঋণ নিয়ে বিনিয়োগ করা। এই তিন ধরনের বিনিয়োগকেই এফডিআই হিসাবে ধরা হয়।২০২৪ সালে আয় থেকে ও ঋণ নিয়ে বিনিয়োগ কমলেও দেশ থেকে বৈদেশিক মুদ্রায় মূল নিয়ে বিনিয়োগের প্রবনতা বেড়েছে।
দেশ থেকে ২০২৩ সালে নিট মূলধন বা বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ে বিদেশে বিনিয়োগ করা হয়েছিল ১ কোটি ১৩ লাখ ডলার। গত বছর নেওয়া হয়েছে ২ কোটি ৪৯ লাখ ডলার। এক বছরে পুজি নেওয়ার প্রবনতা বেড়েছে ১ কোটি ৩৬ লাখ ডলার। বৃদ্ধির হার ১২০ দশমকি ১০ শতাংশ। এ ধরনের পুজি বিদেশে নেওয়ার ক্ষেত্রে এটি একটি রেকর্ড।
বিদেশে দেশি উদ্যোক্তাদের কোম্পানিগুলো তাদের অর্জিত মুনাফা থেকে সংশ্লিস্ট বিনিয়োগ করতে পারে। ২০২৩ সালে মুনাফা থেকে পুনরায় বিনিয়োগ করা হয়েছিল ২ কোটি ডলার। গত বছরে করা হয়েছে ১ কোটি ২৯ লাখ ডলার। আলোচ্য সময়ে এ খাতে বিনিয়োগ কমেছে ৭১ লাখ ডলার। কমার হার ৩৫ দশমিক ৫০ শতাংশ। আন্ত:কোম্পানি থেকে ঋণ নিয়ে বিনিয়োগ করার প্রবনতাও কমেছে। বরং কোম্পানিগুলো আগের নেওয়া ঋণ পরিশোধ করছে। ২০২৩ সালে আন্ত:কোম্পানি ঋণ পরিশোধ করেছিল ২ কোটি ৫৭ লাখ ডলার। গত বছরে পরিশোধ করা হয়েছে ৩ কোটি ৬ লাখ ডলঅর। ঋণ পরিশোধ বেড়েছে ৪৯ লাখ ডলার। পরিশোধের হার বেড়েছে ১৯ শতাংশ।
এদিকে বিদেশে বাংলাদেশিদের বিনিয়োগের স্থিতি কিছুটা কমেছে। ২০২৩ সালে স্থিতি ছিল ৩৫ কোটি ৬ লাখ ডলার। গত বছরে তা কমে স্থিতি দাড়িয়েছে ৩২ কোটি ২৩ লাখ ডলার। ওই সময়ে কমেছে ৮ দশমকি ০৯ শতাংশ। ্এর আগে ২০২১ সালে বিেিদশি বিনিয়োগের স্থিতি বেড়ে সর্বোচ্চ ৩৭ কোটি ৮৮ লাখ ডলার ওঠেছিল। ২০২১ সালের তুলনায় ২০২২ সালে স্তিতি কমেছিল ১৩ দশমকি ৫৬ শতাংশ। ২০২২ সালের তুলনায় ২০২৩ সালে বেড়েছিল ৭ দশমিক ০৭ শতাংশ।
বাংলাদেশ থেকে সবচেয়ে বেশি পুজি নেওয়া হয়েছে ভারতে ৩ কোটি ২০ লাখ ডলার। দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে আরব আমীরাতে ১ কোটি ৪৩ লাখ ডলার। তৃতীয় হংকংয়ে ১ কোটি ৮৯ লাখ ডলার। আয়ারল্যান্ডে ২২ লাখ ডলার। দক্ষিণ আফ্রিকায় ৭ লাখ ডলার।
বিদেশে সবচেয়ে বেশি পুজি নেওয়া হয়েছে আর্থিক প্রতিষ্ঠান খাতে, এরপরে খনিজ সম্পদ খাতে, তৃতীয় মেশিনারি খাতে, চতুর্থ টেক্সটাইল খাতে। এছাড়া সেবা খাত, ট্রেডিং ব্যবসা, ফার্মা খাতে কিছু পুজি নেওয়া হয়েছে।
প্রতিবেদেন থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা যায়, বাংলাদেশে এফডিআই আসার প্রবনতা কমছে। গত ২০২২ সাল থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত এই টানা তিন বছর দেশে বিদেশি বিনিয়োগ কমেছে। ২০২১ সালে বিনিয়োগ বেড়েছিল ৭ দশমিক ৩০ শতাংশ। ২০২২ সালে তা কমে সাড়ে ৩ শতাংশ। ২০২৩ সালেও কমেছে সাড়ে ৩ শতাংশ। ২০২৪ সালে এসে কমেছে ১৩ দশমিক ২০ শতাংশ। ২০২০ সালের পর এটি সর্বোচ্ছ। ওই বছরে কমেছিল ২১ শতাংশ।
সালে বিদেশি বিনিয়োগ এসেছিল ১৪৬ কোটি ডলার। গত বছরে এসেছে ১২৭ কোটি ডলার। গত বছর আসা মোট বিদেশি বিনিয়োগের মধ্যে সবচেয়ে বেশি এসেছে দেশে কার্যরত বিদেশি কোম্পনিগুলোর এক কোম্পানি থেকে অন্য কোম্পানির ঋণ হিসাবে। এর মধ্যে আন্ত:কোম্পানির ঋণ হিসাবে এসেছে ৬২ কোটি ২০ লাখ ডলার। যা মোট বিনিয়োগের ৪৯ শতাংশ। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ এসেছে নিট মূলধন হিসাবে ৫৪ কোটি ৪৬ লাখ ডলার। যা মোট বিনিয়োগের ৪৩ শতাংশ। মুনাফা থেকে পুনরায় বিনিয়োগ করা থেকে এসেছে ১০ কোটি ৩৮ লাখ ডলার।
সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ এসেছে টেডিং খাতে। মোট বিনিয়োগের ৩২ দশমিক ৮০ শতাংশ। বাকি বিনিয়োগ অন্যান্য খাতে।
প্রতিবেদন থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা যায়, এক বছরের হিসাবে বৈদেশিক ঋণ বেড়েছে। তবে তিন মাসের হিসাবে কমেছে। ২০২৩ সালে মোট বৈদেশিক ঋণের স্থিতি ছিল ১০ হাজার ২৩ কোটি ডলার, গত বছরে তা বেড়ে দাড়িয়েছে ১০ হাজার ৩৬৪ কোটি টাকা ডলার। এক বছরে বৈদেশিক ঋণ বেড়েছে ৩৪১ কোটি ডলার। ঋণ বৃদ্ধির হার ৩ দশমকি ৪০ শতাংশ। তবে সেপ্টেম্বরের পর ঋণ পরিশোধ করায় স্তিতি কিছুটা কমেছে।
২০২৩ সালে জিডিপির হিসাবে ঋণ ছিল ২২ দশমিক ২০ শতাংশ। গত বছর তা বেড়ে দাড়িয়েছে ২৩ শতাংশে। জিডিপির তুলনায় সরকারি খাতের ঋণ বাড়ছে, বেসরকারি খাতের ঋণ কমছে।
দেশের মোট বৈদেশিক মুদ্রার রিজাভের অনুপাতে বৈদেশিক ঋণ বেড়েছে। ২০২৩ সালে ছিল ২১ দশশকি ৮০ শতাংশ। গত বছর তা কমে ২০ দশমকি ৬০ শতাংশে দাড়িয়েছে। আলোচ্য সময়ে বৈদেশিক ঋণ বাড়ায় ও জিডিপির আকার কমায় এমনটি হয়েছে। তবে আন্তর্জাতিক মানদন্ড অনুযায়ী এখনও বৈদেশিক ঋণের অনুপাত ঝুকিমুক্ত।