নিজস্ব প্রতিবেদক
সরকারি বেসরকারি খাতের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো পরিচালনায় উদ্যোক্তা পরিচালকদের বেপরোয়া বা আগ্রাসী ক্ষমতায় লাগাম টানা হচ্ছে। নিজ ব্যাংক থেকে কোন পরিচালক নিজের বা স্বার্থ সংশ্লিস্ট প্রতিষ্ঠানের নামে ঋণ বা অন্য কোন সুবিধা নিতে গেলে পর্ষদ সভায় তিনি কোন মতামত বা ভোট দিতে পারবেন না। বিনা জামানতে কিংন্বা ব্যক্তিগত গ্যারান্টিতে কোন ঋণ বা পরোক্ষ সুবিধা নিতে পারবেন না। পরিচালকের পরিবারের বা তার ওপর নির্ভরশীল কোন ব্যক্তির প্রতিষ্ঠান থেকে নিজ ব্যাংকে কোন ধরনের সেবা নেওয়া বা কাজ দেওয়া যাবে না। পরিচালকদের ক্ষমতার প্রয়োগ থাকবে কেবলমাত্র পর্ষদের বৈঠকে ও পর্ষদ কর্তৃক অনুমোদিত কোন কমিটি বা দায়িত্বের মধ্যে। পর্ষদের বাইরে ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের ওপর পরিচালকদের প্রভাব খাটানোর বিষয়টি কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে কঠোরভাবে তদারকি করা হবে। ব্যাংকিং খাতের নানা বিষয়ে তথ্য সংগ্রহের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকে নিজস্ব গোয়েন্দা ইউনিট গঠণ করা হবে।
ব্যাংক খাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ জোরদার, ব্যাংক খাতকে শৃংখলায় আনা ও সুশাসন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ব্যাংক কোম্পানি আইনকে সহয়োপযোগী করে সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সংশোধনের লক্ষ্যে প্রনীত ব্যাংক কোম্পানি আইনের খসড়া থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
সূত্র জানায়, ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে ব্যাংক খাতে সুশাসনের বড় ঘাটতি ছিল্ যে কারণে ব্যাংক দখল হয়েছে, লুটপাট হয়েছে। ব্যাংক এখন টাকার সংকটে ভুগছে। অনেক ব্যাংক আমানতকারীদের টাকা দিতে পারছে না। গ্রাহকদের চাহিদা মত ঋণের জোগানও দিতে পারছে না। প্রচলিত আইন না মানা ও আইন ভঙ্গের দায়ে নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষকে জবাবদিহিতার আওতায় না আনার কারণে জাল জালিয়াতি হয়েছে। আর্থিক খাতে জাল জালিয়াতি রোধে ও ব্যাংক খাত সংস্কারে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তত্বাবধানে একটি টাস্কফোর্স গঠণ করা হয়েছে। তারা আইনী কাঠামো শক্তিশালী করার জন্য কাজ করছে। এর মধ্যে ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধনের বিষয়টিও রয়েছে।
২০০১ সালে বিএনপি সরকার ক্ষমতায় এসে ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধন করে পর্ষদে পরিচালকের সংখ্যা ৯ জনে সীমিত করে। একই সময়ে একই পরিবার থেকে ২ জনের বেশি পরিচালক থাকতে পারবে না, কোন পরিচালক নানা দুই মেয়াদে (এক মেয়াদ তিন বছর) ৬ বছরের বেশি থাকতে পারবে না বলে বিদান করে। ২০০৭ সালে তত্বাবদায়ক সরকার এসেও এগুলো বহাল রাখে। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে ব্যাংক পরিচালকদের বেপরোয়া ক্ষমতা দিয়ে ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধন করে। কয়েক দফা সংশোধন করে পরিচালকদেও ক্ষমতা বাড়ানো হয়। বর্তমানে ব্যাংকের পর্ষদে পরিচালকের বিষয়ে কোন সীমা নেই। ফলে কোন কোন ব্যাংকে গত সরকারের সময়ে ২৭ জনও পরিচালক ছিলেন। আমানতকারীদের স্বার্থ রক্ষায় ব্যাংকে স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগের বিধান করা হলেও গত সরকারের আমলে এই পদে নিয়োগ দেওয়া হতো উদ্যোক্তা পরিচালকদের অনুগত ব্যক্তিদের। অথচ একানে স্বাধীনভাবে ব্যাংকিং বিষয়ে অভিজ্ঞ লোকদের নিয়োগ দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু হয়নি। স্বতন্ত্র পরিচালকরাও উদ্যোক্তাদের পরিচালকদের সঙ্গে মিলে আমানতকারীদের অর্থ লোপাট করেছে। একই সময়ে একই পরিবারের ৩ জন পরিচালক ছিলেন। পরিচালকরা টানা ৪ মেয়াদে ১২ বছর থাকতে পারতেন। পরে তা তিন বছর কমানো হয়। এখন নয় বছর থাকতে পারেন।
ব্যাংক সংস্কারের লক্ষ্যে গঠিত টস্কফোর্স মনে করে এসব বিধি বিধান সুশাসনের পরিপন্থি। এ জন্য সংশোধীত আইনে ব্যাংকের পর্ষদে পরিচালকের সংখ্যা কমিয়ে সর্বোচ্চ ১২ জন করা হচ্ছে। সে ক্ষেত্রে অর্ধেক থাকবে স্বতন্ত্র পরিচালক। মূল পরিচালক ৯ জন থাকলে স্বতন্ত্র পরিচালক থাকবে ৪ জন। এসব পরিচালকদের মধ্যে একজন থাকবেন ব্যাংকের প্রদান নির্বাহী। তিনি শুধু প্রস্তাব ও মূল্যায়ন প্রতিবেদন উপস্থাপন করবেন। কোন মতামত বা ভোট দিতে পারবেন না। স্বতন্ত্র পরিচালকদের সংখ্যা উদ্যোক্তাদের পরিচালকদের সমান সমান রাখার কথা বলা হয়েছে। এতে ভোট বা মতামত দেওয়ার ক্ষেত্রে উদ্যোক্তা পরিচালকদের চেয়ে স্বতন্ত্র পরিচালকদের মতামতকে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। বর্তমানে স্বতন্ত্র পরিচালকদের মতামতকে তেমন গুরুত্ব দেওয়া হয় না। স্বতন্ত্র পরিচালক কোন ঋণের বিষয়ে বা পর্ষদে উপস্থাপিত অন্য কোন বিষয়ে জোরালো আপত্তি উপস্থাপন করলে তা অবম্যই গুরুত্ব সহকারে নিতে হবে। স্বতন্ত্র পরিচালকের মতামত উপক্ষো করে পর্ষদ সংখ্যা গরিষ্ঠ ভোটেও ওই সিদ্ধান্ত নিতে পারবে না। বর্তমাসে স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগ করে পর্ষদ সদস্যরা। নতুন আইনে স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগের ক্ষমতা ব্যাংকের পর্ষদের হাত থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হাতে আনার প্রস্তাব করা হয়েছে। স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক ব্যাংকিং, ব্যবসা বাণিজ্য ও অর্থনীতি বিষয়ে অভিজ্ঞদের নিয়ে একটি প্যানেল তৈরি করবে। এ প্যানেল থেকে স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগ দেওয়া হবে। তারা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে জবাবহিদি করবে, ব্যাংকের পর্ষদের কাছে নয়। এভাবে স্বতন্ত্র পরিচালকদের ক্ষমতায়ন করা হবে। ব্যাংকিং, ব্যবসা বাণিজ্য ও অর্থনিিত বিষয়ে যতেষ্ট অভিজ্ঞতা না থাকলে যেমন স্বতন্ত্র পরিচালক হওয়া যাবে না। তেমনি উদ্যোক্তা পরিচালকও হওয়া যাবে না। বর্তমানে উদ্যোক্তা পরিচালক হতে ওইসব বিষয়ে কোন অভিজ্ঞতার প্রয়োজন হয় না।
সংশোধিত আইনের খসড়ায় একই সময়ে একই পরিবারের দুই জনের বেশি পরিচালক থাকতে পারবে না। এমন কি পরিচালকের স্বার্থ সংশ্লিস্ট ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের পক্ষেও কোন পরিচালক থাকতে পারবে না। কোন পরিচালক বা তার পরিবারের সদস্যদের ব্যাংকের মোট শেয়ারের ১০ শতাংশের বেশি শেয়ার ধারন করতে পারবে না। বর্তমানে এই আইন থাকলেও এটি মানা হচ্ছে না। বেনামে শেয়ার ধারন করে ব্যাংক দখল করা হয়েছে। এটি বন্ধ করতে বেনামী শেয়ারের মালিকানা নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে। তারপর ওই শেয়ার থেকে পরিচালক হতে পারবে। আর যদি কোন শেয়ারের মালিকানা না পাওয়া যায় তবে তা সরাসরি বাজেয়াপ্ত করা হবে। আর বেনামী শেয়ারের কোন সুবিধাভোগী পাওয়া গেলে এর দায় ওই সুবিধাভোগীকে দিতে হবে। ৫ শতাংশের বেশি থেকে ১০ শতাংশ শেয়ার থাকলে ওই পরিবার থেকে ২ জন পরিচালক একই সময়ে থাকতে পারবে। এর কম শেয়ার থাকলে একজন থাকতে পারবে। কোন পরিচালকের মেয়াদ দুই মেয়াদের বেশি হবে না অর্থাৎ তিন বছর করে ছয় বছর থাকতে পারবেন।
সরকারি খাতের বিশেষায়িত ব্যাংক ছাড়া সরকারি খাতের বাকি সব বাণিজ্যিক ব্যাংকই বর্তমানে ব্যাংক কোম্পানি আইনের আওতায় পরিচালিত হচ্ছে। সংশোধিত আইনে সরকারি খাতের সব বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোকেও ব্যাংক কোম্পানি আইনের আওতায় আনার প্রস্তাব করা হয়েছে। এতে ব্যাংকগুলোতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ বাড়বে।
সরকারি ব্যাংকগুলোতে অর্থমন্ত্রনালয় নিজস্ব বিবেচনায় পরিচালক নিয়োগ করে। এক্ষেত্রে পরিচালক নিয়োগের একটি নীতিমালা করার কথা বলা হয়েছে। যার আলোকে পরিচালক নিয়োগ হবে। পাশাপাশি তাদের কাজের জবাবদিহিতা বাড়বে। সরকারি খাতের বেসিক ব্যাংক ও জনতা ব্যাংক লুট হলেও পরিচালকদের কোন জবাবদিহিতার আওতায় আনা হয়নি। এবারের সংশোধনীতে সরকারি ব্যাংকের পর্ষদের পরিচালকদেরও জবাবদিহিতার আওতায় আনার কথা বলা হয়েছে।
বর্তমানে পরিচালকরা নিজ ব্যাংক থেকে তার মোট শেয়ারের ৫০ শতাংশ ঋণ নিতে পারেন। এক্ষেত্রে পরিচালকের শেয়ারের মূল্য সম্পর্কে মূল্যায়নের ক্ষমতা কেন্দ্রীয় ব্যাংকে দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। এরভিত্তিতে নির্ধারিত হবে তিনি কত ঋণ পাবেন। নিজ ব্যাংক থেকে কোন পরিচালক নিজের বা স্বার্থ সংশ্লিস্ট প্রতিষ্ঠানের নামে ঋণ বা অন্য কোন সুবিধা নিতে গেলে পর্ষদ সভায় তিনি কোন মতামত বা ভোট দিতে পারেন। সংশোধীত আইনে বলা হয়েছে, এক্ষেত্রে তিনি নিজের মতামত বা ভোট দিতে পারবেন না।
বর্তমানে কোন পরিচালক বিনা জামানতে কিংন্বা ব্যক্তিগত গ্যারান্টিতে নিজ ব্যাংক থেকে ঋণ বা অন্য কোন পরোক্ষ সুবিধা নিতে পারেন্। সংশোধিত আইনে তা পারবেন না। পাশাপাশি পরিচালকের পরিবারের বা তার ওপর নির্ভরশীল কোন ব্যক্তির প্রতিষ্ঠান থেকে নিজ ব্যাংকে কোন ধরনের সেবা নেওয়া বা কাজ দেওয়া যাবে না। বর্তমানে পরিচালকের এ ধরনের প্রতিষ্ঠান ব্যাংকের সঙ্গে ব্যবসা করতে পারেন।
সংশোধীত আইনে বলা হয়েছে, পরিচালকদের ক্ষমতার প্রয়োগ থাকবে কেবলমাত্র পর্ষদের বৈঠকে ও পর্ষদ কর্তৃক অনুমোদিত কোন কমিটি বা দায়িত্বের মধ্যে। পর্ষদের বাইরে ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের ওপর পরিচালকদের প্রভাব খাটানোর বিষয়টি কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে কঠোরভাবে তদারকি করা হবে।
ব্যাংকিং খাতে সংঘঠিত জাল জালিয়াতির তথ্য সব সময় কেন্দ্রীয় ব্যাংক পাচ্ছে না। অনেক সময় দেরিতে পাচ্চ্ েব্যাংক খাতের হালনাগাদ তথ্য দ্রুত সংগ্রহের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকে নিজস্ব গোয়েন্দা ইউনিট গঠণ করা হবে। যারা গোপনে ব্যাংক খাতের নানা বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করবেন।
