আমানউল্লাহ
ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে লুটপাটের ক্ষত এখন ব্যাংক খাতে ছড়িয়ে পড়ছে। লুটপাটের সব ঋণই এখন খেলাপি হচ্ছে। এসব ঋণ দীর্ঘ সময় ধরে পরিশোধিত না করার কারণে খেলাপি ঋণের তিনটি ধাপের মধ্যে শেষ ধাপে অর্থাৎ আদায় অযোগ্য কু-ঋণ বা মন্দ ঋণে পরিণত হচ্ছে। এসব ঋণ আদায় হওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে বলে এর বিপরীতে ব্যাংকগুলোকে অর্জিত মুনাফা থেকে শতভাগ প্রভিশন রাখতে হয়। যেভাবে মন্দা ঋণ বাড়ছে, সেভাবে মুনাফঅ বাড়ছে না। ফলে ব্যাংকগুলো মন্দ ঋণের বিপরীতে চাহিদা অনুযায়ী প্রভিশন রাখতে পারছে না। এতে প্রভিশন ঘাটতি বাড়ছে। পাশাপাশি ব্যাংকের ঝুকিপূর্ণ সম্পদও বেড়ে যাচ্ছে। ফলে ঝুকিপূর্ণ সম্পদের বিপরীতে চাহিদা অনুযায়ী মূলধন রাখা সম্ভভব হচ্ছে না। ফলে ব্যাংকগুলোর মূলধন কমে গেছে স্মরণ কালের সর্বনিম্ম পর্যায়ে। এতে ব্যাংকগুলো আর্থিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ছে। দুর্নামের কারণে আন্তর্জাতিক ব্যবসায় খরচ বেড়ে গেছে। যে কারণে উদ্যোক্তাদের ব্যবসা খরচ খরচ বেড়ে গিয়ে পণ্যের দামও বেড়ে যাচ্ছে। একই সঙ্গে ঋণের সুদের হার বাড়ছে ও ব্যাংকের শেয়ারে বিনিয়োগকারীরা প্রত্যাশিত লভ্যাংশ থেকে বঞ্ছিত হচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, গত বছরের মার্চে ব্যাংকখাতে খেলাপি ঋণ ছিল ১ লাখ ৬৬ হাজার ২৯৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে মন্দ ছিল ১ লাখ ৫৪ হাজার ১১৫ কোটি টাকা। যা মোট খেলাপি ঋণের ৮৪ দশশকি ৫৪ শতাংশ। অর্থাৎ খেলাপি ঋণের সিংহভাগই ছিল আদায় অযোগ্য। গত বছরের ডিসেম্বরে মোট কেলাপি ঋণ ছিল ৩ লাখ ৫ হাজার ৭৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে মন্দ ঋণ ছিল ২ লাখ ৯১ হাজার ৫৩৮ কোটি টাকা। যা মোট খেলাপি ঋণের ৮৪ দশমকি ৩২ শতাংশ। চলতি বছরের মার্চে মোট খেলাপি ঋণ বেড়ে দাড়িয়েছে ৩ লাখ ৫৭ হাজার ৬৫৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে মন্দ ঋণ হচ্ছে ৩ লাখ ৪২ হাজার ৬৫ হাজার কোটি টাকা। যা মোট খেলাপির ৮১ দশমকি ৩৮ শতাংশ। এক বছরের ব্যবধানে মন্দ ঋণ শতকরা হারে সামান্য কমলেও পরিমাণ বেড়েছে ১ লাখ ৮৮ হাজার কোটি টাকা। অস্বাভাবিক হারে মন্দ ঋণ বাড়ার কারণে ব্যাংকগুলোর প্রভিশন ঘাটতি মারাত্মকভাবে বেড়ে গেচে। কারণ মন্দ ঋণের বিপরীতে ঝুকি এড়াতে শতভাগ প্রভিশন রাখতে হয়। ব্যাংকগুলোর মুনাফা কম হওয়ায় ও মন্দ ঋণ বাড়ায় প্রভিশনের চাহিদা বেড়েছে। ফলে চাহিদা অনুযায়ী প্রভিশন রাখতে পারছে না। এতে বেড়ে গেছে প্রভিশন ঘাটতি। গত বছরের মার্চে প্রভিশন ঘাটতি ছিল ২৬ হাজার ৫৮৬ কোটি টাকা। গত বছরের ডিসেম্বরে তা বেড়ে লাখ কোটি টাকা অতিক্রম করে দাড়ায় ১ লাখ ৬ হাজার ১৩১ কোটি টাকা। চলতি বছরের মার্চে তা আরও বেড়ে দাড়ায় ১ লাখ ৭০ হাজার ৬৫৫ কোটি টাকা। ঋণের বিপরীতে চাহিদা অনুযায়ী প্রভিশন থাকলে ঝুকি কম থাকে। আর প্রভিশন ঘাটতি হলে ঝুকি বেড়ে যায়। গত বছরের মার্চে ৭৬ শতাংশ ঋণের বিপরীতে প্রভিশন ছিল। গত মার্চে তা কমে মাত্র ৩৮ শতাংশ ঋণের বিপরীতে প্রভিশন রয়েছে। অর্থাৎ ৬২ শতাংশ ঋণের বিপরীতে কোন প্রভিশন নেই। ফলে ব্যাংকগুলোর ৬২ শতাংশ ঋণই ঝুকিতে পড়েছে। এই ঝুকি সার্বিকভাবে ব্যাংকের ওপরে আঘাত করছে।
সূত্র জানায়, ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ ও মন্দা ঋণ বাড়ার কয়েকটি কারণ রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে গত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ব্যাংক খাতে বড় ধরনের লুটপাট হয়েছে। ঋণের নামে ওইসব টাকা বিদেশে পাচার করা হয়েছে। প্রায় ৪ লাখ কোটি টাকা ব্যাংক থেকে ঋণের নামে জালিয়াতির মাধ্যমে সরানো হয়েছে। এগুলো এখন সব খেলাপি হচ্ছে। আগে ঋণ খেলাপি যোগ্য থাকলেও সেগুলো খেলাপি হিসাবে দেখানো হয়নি। এখন সেগুলো খেলাহি হিসাবে চিহ্নিত করা হচ্ছে। রাজনৈতিক চাপে ও বিমেষ সুবিধায় খেলাপি ঋণ নবায়নের প্রবনতাও বন্ধ রয়েছে। ফলে খেলাপি ঋণ বেড়ে গেছে। এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে মন্দা ঋন।
ব্যাংকগুলোতে ঝুকিপূর্ণ সম্পদের বিপরীতে কমপক্ষে ১০ শতাংশ মূলধন রাখতে হয়। খেলাপি ঋণ ও প্রভিশন ঘাটতি বাড়ার কারণে ব্যাংকগুলোর ঝুকিপূর্ণ সম্পদ বেড়ে গেছে। ব্যাংকগুলোর আয় কম হওয়ার কারণে মুনাফা থেকে মূলধনে অর্থ স্থানান্তর করতে পারছে না। ফলে মূলধন বাড়ানো যাচ্ছে না। এছাড়া প্রভিশন ঘাটতি থাকায় অনেক ব্যাংক রাইট শেয়ার বা বোনাস শেয়ার দিয়ে মূলধন ঘাটতি মেটাতে পারছে না। ফলে লুটপাটের শিকার বেশ কিছু ব্যাংক মূলধন সংকটে পড়েছে। ২০০৫ সাল থেকে গত বছরের জুন পর্যন্ত ব্যাংক খাতে গড়ে মূলধন রাখার হার ডাবল ডিজিটে অর্থাৎ ১০ শতাংশের ওপরে ছিল। তবে কিছু ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি ছিল। গত ডিসেম্বরে এসে মূলধন রাখার হার স্মরণকালের মধ্যে সর্বনিম্মে অর্থাৎ ৩ দশমকি ০৮ শতাংশে নেমেছে। মূলত খেলাপি ঋণ ও প্রভিশন ঘাটতি বাড়ার কারণে মূলধন ঘাটতিও বেড়েছে।
খেলাপি ঋণ বৃদ্ধি ও মূলধন কমার কারণে ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগযোগ্য তহবিলের পরিমাণ কমে গেছে। ফলে অনেক ব্যাংক নতুন পুজি বিনিয়োগ করতে পারছে না। ফলে তাদের নতুন খাত থেকে আয়ও হচ্ছে না। এ কারণে ব্যাংক আয়ও একেবারে তলানিতে নেমেছে। এর প্রভাবে ব্যাংকের শেয়ারে বিনিয়োগকারীরা যেমন প্রত্যাশিত মুনাফঅ পাচ্ছে না। তেমনি আমানতকারীদের মুনাফা কম দিতে হচ্ছে। উদ্যোক্তাদের ঋণের বিপরীতে চড়া সুদ দিতে হচ্ছে। যা সার্বিকভাবে অর্থনীতিকে ক্ষতিগ্রস্থ করছে।
এখ নপর্যন্ত যেসব ঋণ খেলাপি হচ্ছে তার বেশির ভাগই বানিজ্যিক ঋণ। মেয়াদী ঋণ এখনও সেই হারে খেলাপি হওয়া শুরু হয়নি। মেয়াদী ঋণ খেলাপি হওয়া শুরু করলে খেলাপি ঋণের মাত্রা আরও বেড়ে যাবে। বড় কয়েকটি মিল্প গ্রুপের হাতে এখন পর্যন্ত চলমান ঋণের মধ্যে আড়াই লাখ কোটি টাকা বকেয়া ঋণে পরিণত হয়েছে। পরিশোধ না করা হলে তিন মাস পরই এসব ঋণ খেলাপি হয়ে যাবে।
তবে ব্যাংক খাতে নিদারুন এই মন্দার মধ্যেও বেশ কিছু ব্যাংক ভাল চলছে। তবে সার্বিক মন্দার নেতিবাচক প্রভাব ভাল ব্যাংকের ওপরও পড়েছে।
প্রচলতি নিয়ম অনুযায়ী ব্যাংকগুলো খেলাপি ঋণের বিপরীতে সুদ আরোপ করলেও তা আয় খাতে নিতে পারে না। ওইসব সুদ হিসাব করে আলাদা একটি হিসাবে রাখতে হয়। ঋণ বা ঋণের অংশ বিশেষ আদায় হলে বা ঋণ নবায়ন হলেই কেবল ওইসব সুদ ব্যাংক আয় খাতে নিতে পারে। যে কারণে খেলাপি ঋণের জন্য ব্যাংক আরোপিত ৮২ হাজার ৬২১ কোটি টাকার সুদ আয় খাতে নিতে পারছে না। এগুলোকে স্থগিত সুদ হিসাবে আলাদা একটি একাউন্টে রাখতে হচ্ছে। শুধু খেলাপি ঋণের কারণে ব্যাংকগুলো এতো কোটি টাকার আয় থেকে বঞ্ছিত হচ্ছে।
প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, সার্বিকভাবে খেলাপি ঋণের আগের ধাপে অর্থাৎ বিশেষ হিসাবে রয়েছে আরও ৫০ হাজার ৫৫৮ কোটি টাকার ঋণ। এগুলো পরিশোধ না করা হলেই আগামী তিন মাসের মধ্যে খেলাপি ঋণের প্রথম ধাপ নিম্মমান ঋণে পরিণত হবে। বিশেষ হিসাবে কোন ঋণ নাম লেখালেই তার বিপরীতে ব্যাংকগুলোতে ৫ শতাংশ হারে প্রভিশন রাখতে হয়। এ খাতে আরোপ করা ৩ হাজার ৮১ কোটি টাকার সুদ ব্যাংকগুলো আয় খাতে নিতে পারছে না।
বিশেষ থেকে নিম্মমান হিসাবে খেলাপি হলেই তার বিপরীতে ২০ শতাংশ প্রভিশন রাখতে হয়। আরও তিন মাস পর তা সন্দেহজনক ঋণে পরিণত হবে। তখন ৫০ শতাংশ প্রভিশ রাখতে হবে। মন্দ হিসাবে শ্রেণীকৃত হলে রাখতে হবে শতভাগ প্রভিশন। সূত্র জানায়, এভাবে ব্যাংক খাতে লুটপাটের চিত্র যত প্রকাশ্যে আসছে, ব্যাংকগুলোর অবস্থা ততই খারাপ হচ্ছে।