নিজস্ব প্রতিবেদক
জুলাই গণঅভ্যুত্থানে শহীদদের স্মরণে লাল জুলাই দিবস পালন করা হয়েছে। দেশের বিভিন্ন স্থানে রেড জুলাই বা লাল জুলাই কর্মসূচী পালন করা হয়। তথ্য মন্ত্রনালয়ের উদ্যোগে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমীতে লাল জুলাই দিবস উপলক্ষ্যে ছিল নানা কর্মসূচী। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যারয়েও প্রতীকী প্রতিবাদ হিসেবে মুখে লাল কাপড় বেঁধে ‘অদম্য-২৪’ স্মৃতিস্তম্ভের দিকে পদযাত্রা করে শিক্ষার্থী ও শিক্ষকরা।
জুলাই গণঅভ্যুত্থানের স্মৃতিতে ‘লাল জুলাই’ নিয়ে শিল্পকলা একাডেমিতে সেমিনার ও নাটক মঞ্চায়ন করা হয়েছে। ‘জুলাই পুনর্জাগরণ’ মাসব্যাপী রাষ্ট্রীয় কর্মসূচির অংশ হিসেবে বুধবার ছিল বিশেষ কর্মসূচি ‘লাল জুলাই’।
এদিন দুপুর ১২টায় একাডেমির উন্মুক্ত প্রাঙ্গণে ‘লাল জুলাই’ শীর্ষক আয়োজনে শুরু হয় দিনের কার্যক্রম। উদ্বোধন করেন শহীদ শাহরিয়ার খান আনাসের বাবা সাহরিয়া খান পলাশ ও মা সানজিদা খান দিপ্তী। উপস্থিত ছিলেন শিল্পকলা একাডেমির সচিব ও দায়িত্বপ্রাপ্ত মহাপরিচালক মোহাম্মদ ওয়ারেছ হোসেনসহ বিভিন্ন বিভাগের পরিচালক ও কর্মকর্তারা। এই আয়োজনে ২০ ফুট ব্যাসার্ধের একটি সাদা বৃত্তে আন্দোলনে শহীদ, আহত ও অংশগ্রহণকারীদের প্রতিনিধিত্বে লাল রঙে হাতের ছাপ দেওয়া হয়, যা আন্দোলনের চেতনার প্রতীক হয়ে ওঠে।
লাল জুলাইয়ের কর্মসূচির পেছনে অনেক তাজা প্রাণের রক্ত। এই রক্তের কারণেই এইদিনে ফেসবুক প্রোফাইলটা সবাই লাল করেছিল।
বিকেল ৪টায় একাডেমির সেমিনার কক্ষে অনুষ্ঠিত হয় ‘জুলাই-২৪ এর গণঅভ্যুত্থান ও সংস্কৃতির সংগ্রাম’ শীর্ষক সেমিনার। গণতান্ত্রিক সাংস্কৃতিক ঐক্য আয়োজিত সেমিনারে সভাপতিত্ব করেন সংগঠনের সমন্বয়ক মফিজুর রহমান লালটু, সঞ্চালনা করেন জাকির হোসেন।

সেমিনারে আনু মুহাম্মদ বলেন, যে আকাঙ্ক্ষা নিয়ে দেশের মানুষ গণঅভ্যুত্থানে অংশগ্রহণ করেছিল এবং জীবন দিয়েছিল, অন্তর্বর্তী সরকার তার বিপরীতে হাঁটছে। এ কারণে মানুষ নতুন করে ক্ষোভ প্রকাশ করছেন। বিশেষ করে শ্রমজীবী মানুষের কোনো দাবি এ সরকার কর্ণপাত করছে না।
সাংবাদিক আবু সাঈদ খান বলেন, একটা সাম্প্রদায়িক দক্ষিণপন্থি প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী সামনে আসার চেষ্টা করছে। বামপন্থি ও গণতান্ত্রিক শক্তিগুলোর ঐক্য আজ জরুরি হয়ে পড়েছে।
আরও বক্তব্য দেন দীপা দত্ত, দীনবন্ধু দাশ, সৈয়দ আবুল কালাম, কবি রঘু অভিজিৎ রায় প্রমুখ।
সন্ধ্যা ৭টায় জাতীয় নাট্যশালার মূল হলে মনসুন বিপ্লব ও গণঅভ্যুত্থানকে উপজীব্য করে নির্মিত নাটক ‘রি-রিভোল্ট’ মঞ্চস্থ হয়। নাট্যরচনায় ও নির্দেশনায় ছিলেন নায়লা আজাদ, পরিবেশনায় ছিল ‘টিম কালার’। নাটকটিতে প্রতিবাদী সংগীত, হিপ-হপ, গ্রাফিতি, কবিতা ও নৃত্যের মাধ্যমে একুশ দিনের আন্দোলনের চিত্র তুলে ধরা হয়। এতে অংশ নেন ২০ জনেরও বেশি তরুণ শিল্পী। কোরিওগ্রাফি করেন উম্মে হাবিবা ও সাগত মজুমদার।
নাটকটির সঙ্গে সম্পৃক্তরা জানান, ‘রি-রিভোল্ট’ নাটক হলো একুশ দিনের বিক্ষোভ ও সহিংসতা এবং পরবর্তী গণহত্যার রাস্তার শক্তির প্রতিনিধিত্বকারী নাটকীয় নৃত্য। যেহেতু আমরা কেবল রাস্তার ওপর মনোযোগ দিচ্ছি, তাই আমরা রাস্তার সংগীত এবং নৃত্য, র্যা প ও হিপ-হপ ব্যবহার করেছি। এগুলো প্রতিবাদের সবচেয়ে জরুরি, আপসহীন, নির্মমভাবে সৎ এবং গভীর কাব্যিক প্রকাশ।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে জুলাই গণঅভ্যুত্থানে শহীদদের স্মরণে প্রতীকী ‘রেড জুলাই’ র্যালি এবং শহীদ পরিবার ও আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য মঙ্গলবার এক সম্মাননা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।
সকাল ১১টায় জাবির জহির রায়হান মিলনায়তনের সেমিনার কক্ষে অনুষ্ঠান শুরু হয়। এতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কর্মকর্তা, শিক্ষার্থী এবং আমন্ত্রিত অতিথিরা অংশ নেন। শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বক্তারা ২০২৪ সালের আন্দোলনের তাৎপর্য স্মরণ করেন।
অনুষ্ঠানে জাবির উপ-উপাচার্য (একাডেমিক) অধ্যাপক ড. এম মাহফুজুর রহমান বলেন, ‘গত ১৫ বছর ধরে যারা সাহস করে সত্য বলেছে, তাদের ওপর নানা নির্যাতন চালানো হয়েছে। জুলাই বিদ্রোহ ছিল সেই দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে বড় এক বাঁক বদলের মুহূর্ত।’
তিনি আরও বলেন, ‘শহীদদের আত্মত্যাগ ভুলে যাওয়া বা তাদের আদর্শ রক্ষা করতে ব্যর্থ হওয়া হবে বড় অন্যায়।’
তিনি বলেন, আন্দোলনে শহীদ ও আহতদের স্মরণে বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকটি সড়ক ও অবকাঠামোর নামকরণ করা হবে। ২০২৪ সালে ছাত্রদের ওপর হামলার ঘটনায় দোষীরা শিগগিরই বিচারের মুখোমুখি হবেন বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।
অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ভারপ্রাপ্ত ডিন ও ‘৩৬ জুলাই স্বৈরাচার হাসিনা পতন দিবস পালন কমিটি-২০২৫’-এর আহ্বায়ক অধ্যাপক ড. মো. শামসুল আলম।
অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. এম আবদুর রব, জীববিজ্ঞান অনুষদের ভারপ্রাপ্ত ডিন অধ্যাপক মাফরুহি সাত্তার, প্রক্টর অধ্যাপক ড. এ.কে.এম রাশিদুল আলম এবং পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক অধ্যাপক ড. সালেহ আহম্মদ খান।
শহীদ পরিবারের সদস্যরা অনুষ্ঠানে আবেগঘন স্মৃতি তুলে ধরেন এবং তাদের বেদনা ও গর্বের কথা জানান। সাভার অঞ্চলের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরাও অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন, যারা সরাসরি আন্দোলনে অংশ নিয়েছিল।
অনুষ্ঠানে আন্দোলনে সহযোগিতার জন্য কয়েকটি স্থানীয় প্রতিষ্ঠানকে সম্মাননা স্মারক প্রদান করা হয়। এ ছাড়া সাভার অঞ্চলের শহীদদের স্মরণে নির্মিত একটি প্রামাণ্যচিত্রও প্রদর্শন করা হয়।
এর আগে সকাল ১০টা ৩০ মিনিটে বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনার থেকে ‘রেড জুলাই’ র্যালি শুরু হয়। এতে জাবির শিক্ষক, শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা-কর্মচারী ছাড়াও আশপাশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা অংশ নেন।
প্রতীকী প্রতিবাদ হিসেবে তারা মুখে লাল কাপড় বেঁধে ‘অদম্য-২৪’ স্মৃতিস্তম্ভের দিকে পদযাত্রা করেন।
গণঅভ্যুত্থানের স্মরণে জাবির ছাত্র পরামর্শ ও নির্দেশনা কেন্দ্র গত ২৮ জুলাই থেকে আগামী ২ আগস্ট পর্যন্ত সেলিম আল দীন মুক্তমঞ্চে সপ্তাহব্যাপী সাংস্কৃতিক উৎসব ‘জুলাই গাথা’ আয়োজন করেছে।
