ডেস্ক প্রতিবেদন
মাত্র ১১ বছর বয়সী সম্পূর্ণ নির্দোষ অবস্থানে রাকিব হোসেন ঢাকার রাস্তায় দাঁড়িয়ে ছিলেন। ২০২৪ সালের জুলাইয়ে আন্দোলন দমনের নামে পুলিশের করা গুলি তার মাথায় এসে লাগে। গুলিবিদ্ধ হয়ে তার মৃত্যু ঘটে। পুলিশই গুলি করেছিল। রাকিব হোসেন ছিলেন ১৪০০-এরও বেশি নিহত নারী, পুরুষ ও শিশুর একজন। তারা ‘জুলাই বিপ্লব’ চলাকালীন প্রাণ হারিয়েছেন। সেসময় বাংলাদেশের সর্বত্র লাখো মানুষ তখনকার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে বিদ্রোহে নামে। এই গণ-আন্দোলন দমন করতে শেখ হাসিনা ব্যাপক সংখ্যক সশস্ত্র পুলিশ মোতায়েন করেন। তারা সরাসরি গুলি চালানোর আদেশ পেয়ে সাধারণ মানুষের ওপর গুলি চালাতে থাকে। শেষ পর্যন্ত দমন-পীড়ন ব্যর্থ হয়। ৫ই আগস্ট হাসিনাকে হেলিকপ্টারে দেশ ছেড়ে পালাতে হয়। বিক্ষুব্ধ জনতা তার বাসভবনের দিকে মার্চ করে। সেনাবাহিনী তখন তাদের থামাতে অস্বীকৃতি জানায়।
গত বছরের জুলাই গণ-অভ্যুত্থান নিয়ে এক প্রতিবেদনে এসব কথা লিখেছে অনলাইন গার্ডিয়ান। এতে বলা হয়, রাকিব হোসেনের মৃত্যুর এক বছর পর ৩রা আগস্ট থেকে শেখ হাসিনার বিচার শুরু হয়েছে। রাকিবসহ ওই সময়ে নিহত বহু মানুষের মৃত্যুর জন্য তিনি দায়ী। মাসের পর মাস তদন্ত শেষে বাংলাদেশের প্রসিকিউশন বিভাগ হাসিনার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ এনেছে। এর মধ্যে আছে হত্যা, উস্কানি, ষড়যন্ত্র, হত্যায় সহায়তা, নির্যাতন এবং অমানবিক আচরণের আদেশদানের অভিযোগ। বিচার শুরু করেছে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের (আইসিটি) তিনজন বিচারক। এ আদালত হাসিনা নিজেই তার শাসনামলে প্রতিষ্ঠা করেন। তবে বিচারে শেখ হাসিনা নিজে উপস্থিত থাকছেন না। গত আগস্ট থেকে তিনি ভারতে অবস্থান করছেন। বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার তাকে ফেরানোর জন্য একাধিকবার প্রত্যর্পণের অনুরোধ করেছে। এসব অনুরোধ এখনো উপেক্ষিত। দোষী প্রমাণিত হলে হাসিনার মৃত্যুদণ্ড হওয়ার আশঙ্কা আছে। তাই অনেকেই মনে করছেন তিনি স্বেচ্ছায় ফিরে আসবেন না। তিনি কেবল ‘অপরাধ স্বীকার করছি না’ বলে জানিয়ে বিচার প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। রাষ্ট্রপক্ষ তার জন্য একজন সরকারি নিয়োজিত আইনজীবী নিয়োগ করেছে এবং বিচার হচ্ছে তার অনুপস্থিতিতে। বিচার শুরুর আগের দিনগুলোতে হাসিনা ও তার আওয়ামী লীগ দল ট্রাইব্যুনাল ও বিচার প্রক্রিয়াকে হেয় প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করেছে। তারা অভিযোগ অস্বীকার করেছে এবং বলেছে, তারা আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো আইনি নোটিশ পাননি। শুক্রবার এক খোলা চিঠিতে হাসিনা দাবি করেন, তাকে উৎখাতকারী বিক্ষোভ ছিল ‘আমাদের কঠোর সংগ্রামে অর্জিত গণতন্ত্রের প্রতি সহিংস আঘাত’ এবং তিনি প্রতিশ্রুতি দেন, ‘অবৈধভাবে দখলকৃত প্রতিষ্ঠানগুলো আমরা পুনরুদ্ধার করবো।’
রাকিব হোসেনের পিতা আবুল খায়ের বলেন, আমি চাই হাসিনাকে ব্যক্তিগতভাবে আদালতের কাঠগড়ায় দেখতে। তাকে পরিবারগুলোর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে জবাব দিতে হবে। কিন্তু ভারত তাকে ফেরত দেবে না- সবাই সেটা জানে। ছেলের মৃত্যুর এক বছর পেরিয়ে আবুল খায়েরের শোক রূপ নিয়েছে হতাশায়। তিনি সন্দেহ প্রকাশ করেন যে, ট্রাইব্যুনাল সত্যিকারের বিচার বা দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করতে পারবে কিনা। হাসিনাকে উৎখাতের পর বাংলাদেশে আশাবাদের জোয়ার নামে। শান্তিতে নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে একটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়। তারা গণতান্ত্রিক সংস্কার ও জবাবদিহির প্রতিশ্রুতি দেয়। কিন্তু গত এক বছরে অনেক প্রতিশ্রুতিই বাস্তবায়ন হয়নি। ইউনূস ক্রমবর্ধমান নিরাপত্তাহীনতা ও সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণ ঠেকাতে ব্যর্থ হচ্ছেন। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পর আগামী ফেব্রুয়ারিতে দেশে প্রথম নির্বাচন হবে। আবুল খায়ের আশঙ্কা প্রকাশ করেন যে, এই বিচার রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হতে পারে। তিনি বলেন, সবার জানা, অতীতে এ ধরনের মামলাগুলো বেশির ভাগ সময় রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের হাতিয়ার হয়েছে। কেবল রাজনীতির খেলা চালিয়ে যেতে বছর বছর ধরে এসব বিচার চলতে থাকে। তবু তিনি বলেন, বিচার চলা উচিত, অন্তত সত্যকে নথিভুক্ত করার জন্য। তিনি বলেন, আমি তার মুখোমুখি দাঁড়ানো দরকার মনে করি না। সবাই জানে, তিনিই আদেশ দিয়েছিলেন। সারা বিশ্ব যেন সেটা জানে।
যাদের আত্মীয়স্বজন ২০২৪ সালের জুলাইয়ে নিহত হয়েছেন, তাদের কাছে এই বিচার হলো ন্যায়বিচারের প্রথম ধাপ। হাসিনা প্রশাসনের কিছু উচ্চপদস্থ মন্ত্রী ও পুলিশ কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তার করা হলেও, অনেকেই পালিয়ে এখনো দেশের বাইরে। বিচার স্বচ্ছ করতে বিচারকার্য টেলিভিশনে সরাসরি সম্প্রচার করা হবে, সংবেদনশীল সাক্ষীদের জবানবন্দির সময় ছাড়া।
এটি কেবল শুরু। তদন্তকারীরা হাসিনার ১৫ বছরের শাসনকালে সংঘটিত আরও অনেক অপরাধের অভিযোগে তার বিরুদ্ধে মামলা আনতে কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। এর মধ্যে আছে গুম, হত্যাকাণ্ড, নির্যাতন ও ভিন্নমতাবলম্বীদের বন্দি করা। আইসিটির প্রধান প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম জানান, সেপ্টেম্বর থেকে প্রসিকিউশন ও তদন্ত বিভাগ সাক্ষী ও প্রমাণ সংগ্রহে ‘অবিরামভাবে কাজ করছে’। তিনি বলেন, এটা খুবই কঠিন কাজ। কারণ প্রমাণ ধ্বংস এবং বিপুল সংখ্যক অপরাধীর জড়িত থাকার বিষয়টি এই মামলাকে আরও জটিল করে তুলেছে। তার ভাষায়, কিছু অভিযুক্ত এখনো ক্ষমতার মধ্যে থাকায় অনেক ভুক্তভোগী ও সাক্ষী এগিয়ে আসতে ভয় পাচ্ছেন। তিনি আশাবাদী যে, প্রসিকিউশন যথেষ্ট শক্তিশালী মামলা দাঁড় করাতে পেরেছে। প্রধান সাক্ষীদের একজন হবে হাসিনার সাবেক পুলিশপ্রধান চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল-মামুন। তিনি ইতিমধ্যে দোষ স্বীকার করেছেন এবং হাসিনার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিতে রাজি হয়েছেন।
অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন, শেখ হাসিনার আমলে দুর্বল হয়ে পড়া বিচারব্যবস্থা কি সত্যিকারের স্বাধীন ও নিরপেক্ষ বিচার করতে পারবে? এ বিষয়ে তাজুল ইসলাম বলেন, ট্রাইব্যুনাল এখন আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী সংস্কার করা হয়েছে। এই বিচার ন্যায়বিচার, আইনের শাসন এবং ভুক্তভোগীদের জন্য অত্যন্ত জরুরি। তিনি (হাসিনা) বিচার এড়িয়ে গেলেও, ন্যায়বিচার থেকে রেহাই পাবেন না।
হাসিনার সরকারের সাবেক জ্যেষ্ঠ মন্ত্রী মোহাম্মদ আরাফাত নিজেও অভিযুক্ত। তিনি ট্রাইব্যুনালকে ‘রাজনৈতিক প্রহসনের বিচার’ বলে অভিহিত করেছেন। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ দৃঢ়ভাবে এই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রসূত অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করছে। আমি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানাই, তারা যেন এই ট্রাইব্যুনালকে তার প্রকৃত রূপে চিহ্নিত করে- এটি হচ্ছে রাজনৈতিক বিরোধীদের অপরাধী বানানোর হাতিয়ার এবং বৈধ শাসনকে অপরাধ হিসেবে উপস্থাপনের চেষ্টা।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক মোবাশ্বার হাসান অপহরণ ও নির্যাতনের শিকার হয়ে এখন অস্ট্রেলিয়ার ওয়েস্টার্ন সিডনি ইউনিভার্সিটিতে গবেষণা করছেন। তিনি বলেন, আদর্শ পরিস্থিতিতে হাসিনার বিচার হেগের আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে হওয়া উচিত। ইতিমধ্যে ইউনূস নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার আওয়ামী লীগকে আগাম নির্বাচনে অংশগ্রহণের নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। কিন্তু সমালোচকদের মতে, এটি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে খর্ব করছে। কারণ আওয়ামী লীগ এখনো দেশের অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক দল। আসন্ন নির্বাচনে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) বড় জয় পাবে বলে আশা করা হচ্ছে। তাদের নেতৃত্ব দীর্ঘ সময় হাসিনার সরকারের দমন-পীড়নের শিকার ছিল। একইসঙ্গে, হাসিনার আমলে নিষিদ্ধ জামায়াতে ইসলামীও ভালো ফল করতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে- যা দেশের ধর্মনিরপেক্ষ ভিত্তিকে হুমকির মুখে ফেলতে পারে।
