নিজস্ব প্রতিবেদক
সিলেটের ভোগগঞ্জ ও জাফলংয়ে প্রায় শত কোটি টাকার সাদাপাথর লুট করেছে স্থানীয় প্রভাবশালীরা। স্থানীয়ভাবে ১২৩ জনের নাম ওঠে এসেছে পাথর লুটের সঙ্গে জড়িত থাকার দায়ে। এর সঙ্গে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা, ও প্রশাসনের লোকজন জড়িত। তবে
দুদকের রিপোর্টে শুধু রাজনৈতিক নেতারাই নন, কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয়েছে প্রশাসনের কর্মকর্তাদেরও। ভাগের টাকা যেতো ডিসি-এসপিদের কাছেও। রিপোর্টে ৪২ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের নিষ্ক্রিয়তা ও সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ করা হয়েছে।
এদিকে জেলা প্রশাসন গঠিত তদন্ত কমিটিও তাদের রিপোর্ট জমা দিয়েছে। ওই রিপোর্টেও উঠে এসেছে ১২৩ জনের নাম। এ দু’টি তদন্ত রিপোর্টের পর মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকেও আরেক তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। এই কমিটি প্রশাসনসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সদস্যদের দুর্নীতির বিষয়টি দেখবে বলে জানিয়েছে। সাদাপাথর লুটের ঘটনায় এলাকা ঘুরে আসে দুদকের এনফোর্সমেন্ট তদন্ত কমিটির নেতারা। পাঁচ সদস্যের ওই কমিটির নেতারা বুধবার বিকালে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে তাদের রিপোর্ট জমা দেয়। রিপোর্টে পাথর লুটের ঘটনায় সংশ্লিষ্টতায় রাজনীতিবিদদের আসায় তোলপাড় শুরু হয়।
এদিকে জাফলংয়েও সাদা পাথরসহ অন্যান্য পাথর লুটের ঘটনা ঘটেছে। এর সঙ্গেও স্তানীয় রাজনৈতিক নেতা ও ব্যবসায়ীরা জড়িত। দুই স্তান থেকে প্রায় শত কোটি টাকার পাথর লুট করা হয়েছে। এর মধ্যে ভোলাগঞ্জে প্রায় ৮০ কোটি টাকার ও জাফলংয়ে প্রায় ২০ কোটি টাকার পাথর লুট হয়েছে। লুটের ভাগ পুলিস, প্রশাসন ও রাজনৈতিক নেতারাও পেয়েছেন।
বলা হচ্ছে- ওই রিপোর্টের তালিকার শীর্ষে রয়েছে নগর বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত সভাপতি রেজাউল হাসান কয়েস লোদী, সাধারণ সম্পাদক ইমদাদ হোসেন চৌধুরী, নগর জামায়াতের আমীর মো. ফখরুল ইসলাম ও জেলা জামায়াতের সাধারণ সম্পাদক জয়নাল আবেদীন, এনসিপি’র জেলার প্রধান সমন্বয়ক নাজিম উদ্দিন শাহানের নাম। এ ছাড়া, ব্যবসায়ীদের মধ্যে উপজেলা শ্রমিক দলের সাবেক সভাপতি লাল মিয়া, উপজেলা যুবদলের আহ্বায়ক সাজ্জাদ হোসেন ওরফে দুদু, জেলা যুবদলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক রুবেল আহমদ বাহার ও সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক মুসতাকিন আহমদ ফরহাদ, কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা বিএনপি’র সদস্য হাজী কামাল, আওয়ামী লীগের কর্মী বিলাল মিয়া, শাহাবুদ্দিন ও গিয়াস উদ্দিনের নাম রয়েছে। তালিকায় থাকা অন্যরা হচ্ছেন- উপজেলা বিএনপি’র সাবেক দপ্তর সম্পাদক দুলাল মিয়া ওরফে দুলা, উপজেলা যুবদলের যুগ্ম আহ্বায়ক রজন মিয়া, যুবদল নেতা জসিম উদ্দিন ও তার ভাই সাজন মিয়া, উপজেলা বিএনপি’র কর্মী জাকির হোসেন, সদস্য মোজাফর আলী ও মানিক মিয়া, আওয়ামী লীগের কর্মী মনির মিয়া, হাবিল মিয়া ও সাইদুর রহমান, উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি আবদুল ওদুদ আলফু, জেলা যুবদলের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ মকসুদ আহমদ, জেলা বিএনপি’র পদ স্থগিত হওয়া যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক রফিকুল ইসলাম ওরফে শাহপরান ও বহিষ্কৃত কোষাধ্যক্ষ শাহ আলম স্বপন, জেলা যুবদলের বহিষ্কৃত সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক আবুল কাশেম, গোয়াইনঘাটের পূর্ব জাফলং ইউনিয়ন বিএনপি’র সভাপতি আমজাদ বক্স। পাথর লুটপাটে ৪২ জন রাজনীতিক, পাথর ব্যবসায়ীসহ স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তির প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সংশ্লিষ্টতা এনফোর্সমেন্ট অভিযানকালে পাওয়া গেছে বলে দুদক উল্লেখ করেছে। এর মধ্যে বিএনপি’র ২১ জন, জামায়াতের ২ জন, এনসিপি’র ২ জন, আওয়ামী লীগের ৭ জন রয়েছে। অন্যদের রাজনৈতিক পরিচয় জানা যায়নি। ছয়টি ক্যাটাগরিতে পাথর লুটে জড়িত ব্যক্তিদের নাম-পরিচয় এবং সরকারি সংস্থাগুলোর কার কী ভূমিকা ছিল- তা বিস্তারিতভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। প্রতিবেদনে বিভাগীয় কমিশনার, জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, থানার ওসির নিষ্ক্রিয়তা ও লুটেরাদের কাছ থেকে কমিশন নেয়াসহ নানা অভিযোগ আনা হয়েছে।
এদিকে, দুদকের রিপোর্টে সিলেট নগর বিএনপি’র সভাপতি রেজাউল হাসান কয়েস লোদী ও সাধারণ সম্পাদক ইমদাদ হোসেন চৌধুরীর নাম আসায় বিএনপিতে তৈরি হয় তুমুল সমালোচনা। এই অবস্থায় বুধবার রাতে জরুরি সংবাদ সম্মেলন করে নিজেদের অবস্থান পরিষ্কার করেন নগর বিএনপি’র নেতারা। সংবাদ সম্মেলনে তারা দুদককে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে বলেন, পাথর লুটে তাদের কোনো সম্পৃক্ততা নেই। এই তালিকার সত্যতা দুদককে নিশ্চিত করতে হবে। বলেন, বৈধভাবে পাথরকোয়ারি খুলে দেয়ার আন্দোলনে তারা গেছেন। সেখানে সরকারকে সার্বিক দিক বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নিয়ে কোয়ারি খুলে দেয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন। তারা বলেন, আমরা চ্যালেঞ্জ দিয়ে বলছি কোনোভাবেই এই অপকর্মের সঙ্গে প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষভাবে জড়িত থাকার প্রশ্নই আসে না। দুদকের তালিকার বিষয়ে গতকাল সিলেটে সংবাদ সম্মেলন করেছে জামায়াতে ইসলামী। এতে সিলেট জেলা ও নগর জামায়াতের শীর্ষ নেতারা উপস্থিত ছিলেন।
সংবাদ সম্মেলনে নগর জামায়াতের আমীর মো. ফখরুল ইসলাম বলেন, সব ধরনের লুটপাটের বিরুদ্ধে বরাবরই সোচ্চার জামায়াতে ইসলামী। সাদাপাথরের ক্ষেত্রেও জামায়াতের অবস্থান অপরিবর্তিত। বিকালে সিলেটে সংবাদ সম্মেলন করেন জাতীয় নাগরিক কমিটি-(এনসিপি)’র নেতারা। জেলার প্রধান সমন্বয়ক নাজিম উদ্দিন শাহান বলেছেন, ‘আমাদের সঙ্গে দুদকের কেউ যোগাযোগ করেনি কিংবা কোনো তথ্যই নেয়নি। আমাদের দু’জনের ছবি ও নাম এসেছে। আমি চ্যালেঞ্জ দিয়ে বলতে পারি এই পাথর লুটে আমাদের ন্যূনতম কোনো সম্পর্ক নেই। আমাদের ন্যূনতম সম্পর্ক যদি প্রমাণ করতে পারেন, তাহলে দেশের আইনে যে বিচার হবে সে বিচারে আমরা রাজি। আর যদি এটা প্রমাণ না করতে পারেন যে গণমাধ্যমগুলো আমাদের নিয়ে বিভ্রান্তিমূলক সংবাদ প্রকাশ করেছে, আমি আশা করবো আপনারা দুঃখ প্রকাশ করবেন।’
এদিকে, গতকাল সিলেটের সাদাপাথর এলাকা পরিদর্শন করেছেন সিলেটের নবাগত জেলা প্রশাসক সরওয়ার আলম। দুপুরে তিনি তার কার্যালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন। এ সময় তিনি বলেন, ‘আমি চেষ্টা করবো যাতে এখানকার এই খনিজ সম্পদ বা পর্যটন বা প্রবাসী বিষয় যতগুলো আছে সবগুলোকে এড্রেস করতে। তার মধ্যে কিছু বিষয় থাকবে যেগুলো আমি হয়তো বেশি অ্যাটেনশন দেয়ার চেষ্টা করবো। কারণ এখানে যে কয়েকটা বিষয় বললাম সে বিষয় অবশ্যই আমরা চেষ্টা করবো।’ তিনি বলেন, ‘সিলেট যেহেতু একটা পর্যটন এলাকা এবং এখানে প্রচুর ট্যুরিস্ট আসে এবং প্রাকৃতিক সম্পদ রয়েছে, সেহেতু কোনোভাবেই যেন প্রাকৃতিক সম্পদ নষ্ট না হয় সেটাও আমাদের খেয়াল রাখতে হবে এবং এটা শুধু জেলা প্রশাসন বা জেলা প্রশাসক সরকারি কর্মকর্তার একার দায়িত্ব নয়। সকল স্টেকহোল্ডার সবার দায়িত্ব গ্রহণ করতে হবে।
